ফুসফুস ক্যান্সার হলো ফুসফুস কোষের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। প্রতিবছর বিশ্বে ৫৯০,০০০ জন লোক ফুসফুস ক্যান্সারে নতুনভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এর মধ্যে ৮০-৯০ ভাগ ধূমপানজনিত কারণে। তামাকজাত ধূমপানে চার হাজারের মত রাসায়নিক দ্রব্য থাকে, যার ১০০টি ক্যান্সার সৃষ্টি করতে পারে। ধূমপান দ্বারা যে শুধু ফুসফুসের ক্যান্সার সৃষ্টি হয় এমন নয়। ধূমপান দ্বারা কিডনি, পাকস্থলী, মুখগহবর, গলনালী, মলাস্ত্র এবং মহিলাদের জরায়ুমুখ ও যোনীমুখের ক্যান্সারও সৃষ্টি হতে পারে। এক হিসেবে জানা যায়, মহিলাদের মধ্যে ৪৯% ধূমপানজনিত ফুসফুস ক্যান্সার পাওয়া যাচ্ছে। বিগত চল্লিশ বছরে মহিলাদের মধ্যে ধূমপানের মাত্রা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। যেখানে বিশ্বে মহিলাদের স্তন ক্যান্সারে মৃত্যুর হার বেশি ছিল, সেখানে বর্তমানে ফুসফুস ক্যান্সারের আধিক্য দেখা যাচ্ছে। এছাড়া সরাসরি ধূমপানের চেয়ে পরোক্ষ ধূমপানেও যে ফুসফুস ক্যান্সারের মাত্রা বাড়ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই বর্তমানে পরিবেশগত ধূমপান (Enviromental tobacco Smoke-ETS) কে "Known human carcinogen" বলা হয়। এভাবে ধূমপানজনিত ক্যান্সারে দিন দিন মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়িয়ে দিচ্ছে। ধূমপানকে এখন বলা হয়-Slow-Moving Suicide আমরা যদি ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে চাই, তাহলে ধূমপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
ফুসফুস ক্যান্সারের অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বংশগত কারণ পরিবারের আপনজনদের মধ্যে কারো ফুসফুস ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে অন্য সদস্যের মধ্যে তা হতে পারে। অধূমপায়ীদের মধ্যে এ ধরনের ফুসফুস ক্যান্সার হতে পারে। ধূমপান ছাড়া সাদাপাতা, জর্দা, গুল গ্রহণেও ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শিল্পকারখানায় যারা কাজ করেন, কিংবা দীর্ঘসময় ধোয়ার ভেতর কাজ করেন, এমন শ্রমিকদের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে। পরিবেশগত কারণের মধ্যে রেড়ন (radon), অ্যাজবেসটস (asbestos), এবং বায়ু দূষণও ফুসফুস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে থাকে। তাই পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ করেও আমরা ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে পারি। ফুসফুস ক্যান্সার প্রাথমিক স্তরে ধরা বেশ কঠিন। রোগের গভীরতা এবং তীব্রতার সময়ই সাধারণত এর লক্ষণ প্রকাশ পায়। তবে অবিরত কাশি (Persistent cough), বুকে ব্যথা (chest pain), এবং বারবার ব্রঙ্কাইটিসের ইতিহাস থাকলে ফুসফুসে টিউমারের সম্ভাবনা চিন্তা করে থাকেন চিকিৎসকরা। এ ধরনের অবস্থায় সিটি স্ক্যান (CT) দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায়, ফুসফুসে কোন ক্যান্সার অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে কিনা। এক সময় বুকের এক্স-রে দ্বারা এ রোগ নির্ণয়ে কাজ করা হতো। তবে বর্তমানে ক্যান্সার নির্ণয়ে বুকের এক্স-রের গুরুত্ব কম।
ফুসফুস ক্যান্সার নির্ণয়ে যেসব লক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে, কাশি, কাশির সাথে রক্ত, শ্বাসকষ্ট, বুকে ব্যথা, শ্বাস-প্রশাস্বের সময় বাঁশির মতো শব্দ হওয়া, স্বর ভঙ্গ বা গলা বসে যাওয়া, ক্ষুধা মন্দা, ওজন কমে যাওয়া এবং অবসাদগ্রস্ততা। ফুসফুস ক্যান্সারকে প্রধানত দু'ভাগে ভাগ করা হয়- প্রথমতঃ নন-স্মল সেল কারসিনোমা (non-small cell-NSCLC), দ্বিতীয় : স্মল সেল কারসিনোমা (NCLC)। এর মধ্যে নন-স্মল সেল শতকরা ৮০ ভাগ। এছাড়া ফুসফুস শরীরের অন্য অঙ্গের ক্যান্সার থেকে মেটাসটেসিসের মাধ্যমেও ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে থাকে। আবার ফুসফুস ক্যান্সার সহজেই মস্তিষ্ক (brain), হাড় (bones) এবং লিভারে (Liver) মেটাসটেসিস হতে পারে। রোগ নির্ণয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার সহযোগিতা নিয়ে থাকেন। সাধারণত এক্স-রে, সিটিস্ক্যান, স্পুটাম সাইটোলজি, বায়োপসি, ব্রঙ্কোস্কপি, দ্বারা অধিকাংশ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় হয়ে থাকে। বর্তমান অধিকতর প্রযুক্তিনির্ভর পরীক্ষা হিসেবে PET স্ক্যান ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফুসফুস ক্যান্সার ফুসফুসেই শুরু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। কারণ অন্য অঙ্গের ক্যান্সারও ফুসফুসে ছড়িয়ে থাকে মেটাসটেসিস-এর মাধ্যমে। যেমন স্তন ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়াতে পারে, মূলত তা স্তন ক্যান্সারই। এমনিভাবে ক্যান্সার চিকিৎসায় ক্যান্সার উৎস জানা খুবই জরুরি বিষয়। অন্যদিকে ফুসফুস ক্যান্সারের স্তর বিন্যাস (staging) জানাও চিকিৎসার জন্য অত্যাবশ্যক। এই স্তর বিন্যাস দেখেই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিবেন রোগীর জন্য কি ধরনের চিকিৎসা দিতে হবে। এছাড়া রোগরে স্তর বিন্যাস রোগীর ভবিষ্যৎ নির্ধারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফুসফুস ক্যান্সারের আধুনিক চিকিৎসায় রয়েছে সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপী, কেমোথেরাপী।
হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা
ফুসফুস ক্যান্সার চিকিৎসায় অন্যান্য চিকিৎসার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও বেশ ফলপ্রদ। যোগ্য চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে হোমিওপ্যাথি ওষুধ ফুসফুস ক্যান্সারের রোগীদের যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারলে উপকার পাওয়া যায়। ডিগ্রিপ্রাপ্ত এবং ক্যান্সার বিষয়ে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ছাড়া এ ধরনের রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কোনভাবেই ঠিক নয়। এ জন্য চিকিৎসক নির্বাচনে রোগীদেরকে সচেতন থাকতে হবে। যেহেতু আমাদের দেশে ক্যান্সার বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ খুবই সীমিত, তাই যারা ক্যান্সারের জন্য বিকল্প চিকিৎসা হিসেবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিতে চান, তারা সরকার অনুমোদিত সংস্থা, বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক ক্যান্সার সোসাইটির সহযোগিতা নিতে পারেন। এখানে মনে রাখা দরকার যে, বর্তমান বিশ্বে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতি একটি দ্রুত বর্ধনশীন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এগিয়ে আসছে। বাংলাদেশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এখন গুরুত্বের সাথে হোমিওপ্যাথির ওপর উচ্চশিক্ষার প্রবর্তন করেছে। হোমিওপ্যাথির ভাল ভাল ওষুধগুলো ব্যবহার করার জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষিত এবং দক্ষ চিকিৎসক। হোমিওপ্যাথিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ধারণাটিও এখন প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
প্রতিরোধে করণীয় :
ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে প্রথমেই ধূমপান প্রতিরোধ করতে হবে। ধূমপানের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলতে হবে। যারা ধূমপানে অভ্যস্ত তাদেরকে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সরাসরি ধূমপানের চেয়ে পরোক্ষ ধূমপান বেশি ক্ষতিকর। তাই প্রকাশ্য স্থানে, বাসা-বাড়িতে, অফিসে, বাসে, রাস্তাঘাটে, বাজারে যারা ধূমপান করে তাদের সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। বিশেষভাবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যাতে ধূমপান না করেন সে ব্যাপারে স্ব স্ব কর্তৃপক্ষকে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে। সিনেমা, নাটকে যাতে ধূমপানের দৃশ্য না থাকে সে ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। পাড়ায়-মহল্লায় দোকানের সামনে যাতে কেউ ধূমপান না করতে পারে সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট এলাকার যুবসমাজকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিভিন্ন এনজিও এবং সামাজিক সংস্থাকে এ ব্যাপারে ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষভাবে মসজিদে ইমাম সাহেবগণ জুম্মার খুতবায় এ ব্যাপারে সচেতনতামূলক বক্তব্য রাখতে পারেন।
ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে খাবার-দাবারও পুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেমন- সবুজ শাক-সবজি নিয়মিত খেতে হবে। ফলিক এডিস সমৃদ্ধ খাবার, ভিটামিন এ সি ই খেতে হবে। ব্রুকলি, বাধাকপি, ফুলকপি, ফুসফুস ক্যান্সার প্রতিরোধে উপকারী। নিয়মিত ব্যায়াম জরুরি। মানসিক চাপ মুক্ত থাকার চেষ্টা করতে হবে। ইতিবাচক চিন্তা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি ধর্মীয় অনুশীলন আপনাকে ভাল রাখবে।
তবে যত প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথাই বলা হোক, তাতে কোন লাভ হবে না, যদি না ধূমপান বন্ধ করা যায়। তাই আমরা সবাই প্রতিজ্ঞা করি, ধূমপান করব না, ধূমপান করতে দিব না।